কফি ও কাজুবাদাম চাষ দেখিয়ে ৪১ কোটি টাকা লোপাট

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪১ কোটি টাকার কফি ও কাজুবাদাম চাষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু কাজ না করে অথবা নামমাত্র কাজ দেখিয়ে প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।
২০২০ সালে এই প্রকল্প শুরুর আগেই পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সীমিত পরিসরে কফি ও কাজুবাদামের চাষ হয়। সেসব বাগানকে এই প্রকল্পের দেখিয়ে ছবি তোলা হয়। আবার চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিপুল অর্থ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন উপজেলা থেকে কিছু লোক ডেকে নিয়ে প্রশিক্ষণের নামে ছবি তুলে তাদের বিদায় করে দেওয়া হয়। একনেকের অনুমোদন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এই প্রকল্প গ্রহণ করে। এ বছরের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মো. মজিবর রহমান বলেন, পার্বত্যবাসীর সঙ্গে এসব প্রতারণা না করে সঠিক উন্নয়নটি করলে পাহাড়ে সোনা ফলানো যেত। কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারণে পাহাড়ের মানুষ সবসময় উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থাকে। উন্নয়ন প্রকল্পের নয়ছয় করা মানে পুরো একটা অঞ্চলকে পঙ্গু করে দেওয়া। তিনি এসব দুর্নীতি খতিয়ে দেখার জন্য দুদকের প্রতিও আহ্বান জানান।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে প্রকল্প পরিচালক মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইলে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেনি।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ২০০০ পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। কৃষকরা জানান, বাস্তবে সময়মতো কফি ও কাজুবাদামের চারা কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়নি। মাঠপর্যায়ে নজরদারির জন্যও ছিলেন না প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। কাগজে-কলমে অতিরিক্ত নিয়োগ দেখিয়ে প্রকল্পের বাজেট থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালক জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
রাঙামাটি সদর উপজেলার কৃষক সমন চাকমা জানান, আমরা যখন চারা পেলাম তখন বৃষ্টির সময় শেষ। মাটিতে চারা রোপণের সময় পার হয়ে গেছে। পাহাড়ের মাটি দ্রুতই শুকিয়ে যায়। তাই এসব চারা রোপণ করার পর মরেও গেছে।
সরেজমিনে বান্দরবান উপজেলা সদরের প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এক একর জমিতে ৮০০টি কফি গাছ এবং ১২০০টি কাজুবাদাম গাছ লাগানোর কথা বলা হলেও এ ধরনের কোনো বাগানের অস্তিত্ব নেই। কিছু এলাকায় হয়তো চারা দেওয়া হয়েছে, তা সীমিত যার আর কোনো চিহ্ন নেই।
স্থানীয় কৃষকদের দাবি, দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রকল্পের অর্থ ও কাঠামো যথাযথভাবে কৃষকদের কল্যাণে কাজে লাগানো হোক।
প্রকল্পে দুই হাজার পরিবারের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্যও বিপুল বাজেট রাখা হয়েছিল। ৫০০ কৃষকের অভিজ্ঞতা অর্জন সফর এবং ২০০ কৃষককে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
রুমা উপজেলার লালরিন বম জানান, আমাদের কিছু লোককে বান্দরবানের পিডি অফিসে ডাকা হয়। এরপর সবাইকে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলে আর কাগজে সই নেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের নামে আমাদের আনা হয়েছিল। ছবি তোলার পর একটি কাগজে সবার স্বাক্ষর নিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১০টি জিএফএস (লাইন), ১২টি পানির উৎস উন্নয়ন এবং ১৫টি ডিপ ইরিগেশন ইউনিট বসানোর কাজ। যার মাধ্যমে পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে পানি সরবরাহ করে কৃষকদের উৎপাদন বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসব হাতেগোনা কয়েকটি নামমাত্র স্থাপন করে নিয়মনুযায়ী কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে কৃষকরা পানির সংকটে ক্ষতির মুখে পড়েছে, এ প্রকল্পের অনেকেই কফি ও কাজুবাদাম চাষ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার রাঙামাটি সদর, নানিয়ারচর, কাপ্তাই ও জুরাছড়ি উপজেলা, খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াছড়ি সদর, মানিকছড়ি, মাটিরাঙা ও রামগড় উপজেলা ও বান্দরবান জেলার বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল।