বান্দরবানে কাঠ পাচারের গডফাদার ‘ল্যাডা জাহাঙ্গীর’

বান্দরবানের আলোচিত কাঠ ব্যবসায়ী ও বান্দরবান কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ওরফে ‘ল্যাডা জাহাঙ্গীর’-এর বিরুদ্ধে উঠে এসেছে বন লুট, কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, কর ফাঁকি ও চাঁদাবাজির গুরুতর অভিযোগ।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে কাঠ পাচারের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালের এক-এগারো সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে প্রথম কাঠ পাচারের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। অভিযোগ আছে, সেই ২০০৮সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী বীর বাহাদুরের চত্রছায়ায় এখন পর্যন্ত তিনি বান্দরবানে কাঠের রাজ্যে একক আধিপত্য ধরে রেখেছেন।
জানা গেছে, বন থেকে কাঠ পাচার করে তিনি গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বান্দরবানে চৌধুরী মার্কেট এলাকায় গড়ে তুলেছেন বহুতল বিশিষ্ট বিলাসবহুল হক হিল টাওয়ার নামে একটি মার্কেট। শহরের বনরূপা, বিভিন্নস্থানে তার নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে একাধিক ভবন ও জমি। ক্ষমতাসীনদের নাম ব্যবহার করে
কাঠবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে প্রতি রাতেই আদায় করা হয় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা করে। এসব টাকার অংশ যায় স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা, পুলিশ ও বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে। ফলে কালো টাকার ব্যবহার ও ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে বছরের পর বছর কোনো অভিযানেই ধরা পড়েননি ল্যাড়া জাহাঙ্গীর। বরং তার নামেই গড়ে উঠেছে একটি ‘অঘোষিত অবৈধ কাঠ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সিন্ডিকেট’।
স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় জাহাঙ্গীর প্রতিনিয়ত বন উজাড় করে আসছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে শুরু হয় হয়রানি। বন্ধ করে দেয়া হয় অভিযোগকারী ব্যবসায়ীর বৈধ গাড়ি লোডিং। বান্দরবানের উভয় বন বিভাগ যেন তার অধীনস্থ একটা অফিস। অবৈধ ব্যবসার আঁড়ালে জোত ব্যবসার ডি-ফরম লিখা, লকবই লিখা, নোটশীটের কাজ সব কাজই সরকারি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের করার নিয়ম থাকলেও জাহাঙ্গীর এই সবকাজ নিজের লোক দিয়ে তার সুবিধা মতো করান। যাতে অবাধে তার কাঠ পাচার অব্যাহত হবে। বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এই অবৈধ সুবিধা পান তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের অন্যতম অর্থায়নকারী হিসেবে পরিচিত। বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সভা-সমাবেশে আর্থিক সহায়তা আসে তার কাছ থেকেই। মন্ত্রীর আস্থায় থাকার জন্য দুহাতে ব্যয় করেছেন বান্দরবান জেলা কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সিংহভাগ টাকা।
অভিযোগ আছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্রলীগের একাংশকে উসকানি দেন আন্দোলন দমন করতে এবং তৎকালীন বঙ্গবন্ধু মুক্তমঞ্চে ৩দিন দুপুরের খাবারের যোগান দেন। এছাড়া জেলা কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সর্বশেষ নির্বাচনেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভোটারদের ভোটের ছবি তুলতে বাধ্য করেছেন। তা না হলে ব্যবসা বন্ধের হুমকি দিয়েছেন। বিএনপির এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে আঁতাত করে তিনি আবারও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
অর্থ লোপাট, অবৈধ লেনদেন ও সদস্যদের মতামত উপেক্ষার একাধিক লিখিত অভিযোগ সমিতিতে দাখিল হয়েছে। সমিতির তহবিলের নিরীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে হয়নি।
তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, এত বিশাল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিয়মিত কর দেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, তার আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা সম্পদ তার বাস্তব সম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। গত পাঁচ বছরে তিনি যে পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন, তার কোনও বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি।
সরকার একাধিকবার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিলেও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মতো প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সুরক্ষা থাকার কারণে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং বন অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন এই বিষয়ে হাইকোর্টে রিট দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তারা বলছে, একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের আশ্রয়ে বান্দরবানে প্রাকৃতিক সম্পদ হরণ চলছে, যার মূল হোতা এই জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এদিকে বন অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “উপরের চাপ না এলে জাহাঙ্গীরদের কিছু করা যায় না।”
এই বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য জানাতে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ভাই আমি কোথায় চাঁদাবাজি করলাম, কর ফাঁকি দিলাম,আমি অবৈধ সম্পদ কোথায় অর্জন করলাম জানিনা।