প্রকল্পের নামে বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশলীর শত কোটি টাকা লুটপাট

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড দুর্নীতির আরেক আতুরঘর বান্দরবান ইউনিট অফিস। ছোট বড় অন্তত ৫৬ টি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ শত ৮৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সব প্রকল্প থেকে প্রকৌশলীকে দিতে হয়েছে মোটা অংকের পার্সেন্টেজ। অস্তিত্বহীন প্রকল্পের টাকা লুটপাট করতে উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বিন মোহাম্মদ ইয়াছির আরাফাত গড়েছিলো একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট যার মধ্যে রয়েছে আনিছুর রহমান সুজন ও ঠিকাদার অমল কান্তি দাশ। তারা তিন জনে মিলে রাতারাতি টেন্ডার দিয়ে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। যার বেশির ভাগ প্রকল্প কাগজেই সীমাবদ্ধ। সরজমিনে সেই সব কাজের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নাই। এতো কিছুর পরেও তিনি এখনো বহাল তবিয়তে। এখন জেলা বিএনপির এক নেতার হাত ধওে আগের সেই স্টাইলেই চলছে ভাগাভাগি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান ইউনিট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশল আবু বিন মোহাম্মদ ইয়াছির আরাফাত “পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহয়তা আওতায়” ৭ টি উপজেলায় নামে বেনামে ৫৬ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রাতারাতি গোপনে টেন্ডার দিয়ে সব প্রকল্প থেকে টাকা লুটপাট করে। যার মধ্যে ২৮ টি প্রকল্পের ১ শত ২৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
কাগজেই সীমাবদ্ধ কিছু প্রকল্পের মধ্যে বান্দরবান সদর উপজেলার কিবুকছড়া হতে উদালবনিয়া উপর পাড়া রাস্তা ও রাজবিলা-রমতিয়া হয়ে বাঙ্গালহালিয়া পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে ৫ কোটি টাকা। থানচি উপজেলায় ১ নং রেমাক্রী ইউনিয়নের দলিয়ান পাড়া হতে নাফাকুম ঝর্ণা হয়ে রেমাক্রী পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে ১২ টাকা। নাইক্ষংছড়ি উপজেলার স্টেডিয়ামের গ্যালারির অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ দেখিয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। রোয়াংছড়ি উপজেলার বান্দরবান জেলা পরিষদ স্কুল অ্যান্ড কলেজর হোস্টেল ভবন নির্মাণ দেখিয়ে ২ কোটি টাকা। লামা উপজেলার মুরুং হোস্টেল ভবন নির্মাণ দেখিয়ে ১ কোটি টাকা। বান্দরবান সদর উপজেলার এমডিএস হাসপাতাল ভবনের ব্লক ৩ ও ৪ নির্মাণের নাম দিয়ে ৪ কোটি টাকা। বান্দরবান সদরে জেলা বাস টার্মিনালের উন্নয়ন দেখিয়ে ৬ কোটি টাকা। বান্দরবান হিলটপ রেষ্ট হাউজ এর ভবন নির্মাণের নামে ৮ কোটি টাকা। এরকম আরো ২০ টির ওদিক প্রকল্প শুধু কাগজে আছে মাঠে নেই। এসব প্রকল্পের সব টাকায় প্রকৌশলী ইয়াছিন আরফাত ও ঠিকাদার অমলের পকেটে।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ঠিকাদারা বলেন, উন্নয়ন বোর্ডের কাজ নিতে প্রকৌশলীকে অগ্রিম প্রকল্পের ৬ পার্সেন্ট টাকা দিতে হয়। কাজ নেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করার সময় আবার দিতে হয় প্রকল্প ব্যয়ের ৩ পার্সেন্ট টাকা। বিল নেওয়ার সময় অফিস খরছ বলে আবার দিতে ৬ পার্সেন্ট। এছাড়াও ওনার পছন্দের ঠিকাদার না হলে কাজ পাওয়া তো স্বপ্ন। উন্নয়ন বোর্ডে চুরি বললে তো ভুল হবে, এখানে তো সাগর ডাকাতির সেও বেশি হয়।
এর বাহিরও জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায় প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ শেষ না করেই ৯ টি প্রকল্পে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা প্রকৌশলী ইয়াছিন আরফাত পকেটে। এর মধ্যে ২০১১-২০২২ বাস্তবায়নকালে রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর হতে কাইন্তারমুখ পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ব্যয়ে দরা হয়েছে ১০ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যার মধ্যে প্রকৌশলী ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ২০১৪-২০২২ অর্থবছরে খামতং পাড়া হতে পাইক্ষ্যং পাড়া হয়ে রুমা রোনিন পাড়া পর্যন্ত ১০.৫০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৭ কোটি ৮০ লাখ ব্যয়, যার ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ২০১৫-২০২৩ বান্দরবান-রুমা সড়ক হতে কুমি পাড়া থেকে মংঞো পাড়া পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার সড়কে ৭ কোটি টাকা ব্যয়, ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৭-২০২২ নোয়াতং পাড়া হতে ম্রখ্যং পাড়া পর্যন্ত ৩ কোটি টাকার ৪ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২৩ বান্দরবান পার্বত্য জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কতৃক নির্মিত বিভিন্ন রাস্তা সংস্কার করণে ২.৫০ কিলোমিটার রাস্তায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার ৮৫ লাখ টাকা। ২০২০-২৪ কচ্ছপতলী পাড়া হতে চিনি পাড়া হয়ে দেবাতাখুম পাড়া হয়ে লক্ষীচন্দ্র পাড়া পর্যন্ত রাস্তা ও ব্রীজ নির্মাণে ১১ কিলোমিটার রাস্তায় ১১ কোটি টাকার ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০২০-২৩ আলেক্ষ্যং পাড়া পর্যন্ত রাস্তা ১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ২ কোটি ৫ লাখ টাকা। ২০২১-২৪ নোয়াপতংমুখ পাড়া সংলগ্ন নোয়াতং পাড়া খালের উপর ৮০ মিটার সংযোগ সড়কসহ আরসিসি গার্ডার ব্রীজ নির্মাণে ৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ করে সব টাকা প্রকৌশলীর পকেটে। অন্য আর একটি প্রকল্পে ২০২১-২৪ বান্দরবান জেলা পরিষদের স্কুল এন্ড কলেজে ৬৩০ বর্গমিটারের হোস্টেল ভবন নির্মাণে ২ কোটি টাকা কাজ না করে টাকা পকেটে।
লামা উপজেলার লামা উপজেলায় ৪ টি প্রকল্পের কোন কাজ না করেই ১৪ কোটি ৫০ লাখ ও অন্য দিকে ৬ টি প্রকল্পে ৯ কোটি ২২ লাখ টাকা কাজের কোন হদিশ পাওয়া যায় নেই। যার মধ্যে কাজ না করে যে ৪ টি প্রকল্প, ১ নং গজালিয়া ইউনিয়নের ফাদু খালের ব্রীজসহ ৮০ মিটার রাস্তা নির্মাণে ৭ কোটি টাকা। ৩ নং ফাঁসিয়াখালি ইউনিয়নের কুমারী নীচ পাড়া জামে মসজিদ হতে চাককাটা পাড়ায় আলীআকবর বাড়ি হয়ে দোয়াশীয়া গ্রামে ২.২০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মুরুং হোস্টল ১৬৭.৫৫ বর্গমিটার ভবন নির্মাণে ১ কোটি টাকা। লামা বাস টার্মিনালের ৪০০০ বর্গমিটার মাঠ উন্নয়নের নামে ১ কোটি টাকা। অপরদিকে চিউবতলী থেকে গুরুর বাজার পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। রুপসীপাড়া সড়ক হতে ম্যারাখোলা হয়ে ছোট বুম পর্যন্ত ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৩৬ লাখ। ফাইতং হেডম্যান পাড়া হইতে রোয়াজা পাড়া হয়ে কারিয়াং পাড়া পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৯৩ লাখ। আজিজনগর ইউনিয়ন ইসলামিয়া মিশন থেকে (মুসলিম পাড়া হয়ে) চৌধুরী হার্টিকালচারেল এষ্টেট পর্যন্ত ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কিলোমিটার রাস্তার অসমাপ্তকরণে সমাপ্তকরণ ৩ কোটি ৪০ টাকা। কুমারী-লামা-আলীকদম সড়ক হইতে বিছন্যার ছড়া গ্রাম পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ কিলোমিটার ব্রিক সলিং করণে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের রেষ্ট হাউজ কাম অফিসে ১ কোটি ৫০ লাখ ভবন নির্মাণে ১৮ টাকায়।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৮ প্রকল্পে ২৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লুটপাট। চাকঢালা থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ কি:মি: এইচ.বি.বি. করণে প্রায় ১৮ লাখ, আশারতলী হতে প্রধানঝিড়ি হয়ে জামছড়ি পর্যন্ত ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণে প্রায় ৯২ লাখ টাকা। চাক হেডম্যান পাড়া থেকে চঐচ রাবার বাগান হয়ে লংগদু পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কি: মি: রাস্তা নির্মাণে ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সদর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের হামিদায় পাড়া হইতে নিকুছড়ি যাওয়ার ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কি:মি রাস্তা নির্মাণে ৩৩ লাখ টাকা। মোরুং বেলথলি থেকে লধূর মুখ পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণে ৯ কোটি ৮০ টাকা। চাকঢালা প্রধান সড়ক হইতে নতুন চাক পাড়া ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। স্টেডিয়ামের গ্যালারীর অসমাপ্ত কাজ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৪ বর্গমিটার সমাপ্তকরণে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখ। বাস টার্মিনালে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫৩ বর্গমিটার ভবন নির্মাণে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
অপরদিকে রুমা, থানছি ও আলীকদম উপজেলার ২ প্রকল্পে ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা কাজ না করে প্রকল্পের সব টাকা লুটপাট। এর মধ্যে কাজ না করে রুমা বগালেক সড়কের কমলা বাজার হতে চিংলক পাড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তা ও ব্রীজ নির্মাণে ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প ও থামছি উপজেলার বাস টার্মিনালের ২১৭.২২ বর্গমিটার ভবন নির্মাণ ও ভূমি উন্নয়ন প্রকল্পের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা কাজ না অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নেই।
অন্যদিকে আরো ৬ প্রকল্পে প্রায় ১৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা কাজ না করে করে অমলের পকেটে। এর মধ্যে রুমা উপজেলায় এম্পুপাড়্ হতে বটথলী পাড়া পর্যন্ত ৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৩ হাজার টাকা, রুমা-মুন্নামপাড়া সড়ক হতে নিয়াংখ্যাংপাড়া পর্যন্ত ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪.৫০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৪৪ লাখ টাকা, রুমা বাস টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও ভূমি উন্নয়ন এই ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্পে ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, থানছি উপজেলার ৩ নং সদর ইউনিয়নের ছাংদাক পাড়া নির্মাণাধীন ব্রিজ হতে জিনিঅং পাড়া পর্যন্ত ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে প্রায় ২৮ লাখ টাকা ও ১ নং রেমাক্রী ইউনিয়নের দলিয়ান পাড়া হতে নাফাকুম ঝর্ণা হয়ে রেমাক্রী বাজার পর্যন্ত ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ১১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা পকেটে। পরদিকে আলীকদম উপজেলার তৈন কলার ঝিড়িহতে মংচা পাড়া হয়ে রোয়াম্ভু পর্যন্ত ৩ কিলোমিটারে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তা উন্নয়নে ৩৩ লাখ টাকা পকেটে। এই বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেনি।