বর্জ্যে দুষিত হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

একটি নাম , যা দেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনে এক অপার ভালোলাগার প্রতিচ্ছবি। কাপ্তাই লেকের নীল জলরাশি , সবুজ পাহাড় , জনজাতি সংস্কৃতি — সবকিছু মিলিয়ে যেন প্রকৃতি এখানে নিজ হাতে রচনা করেছে এক অনুপম চিত্রপট। কিন্তু এই সৌন্দর্যের নগরীর প্রবেশমুখেই চোখে পড়ে এক ভিন্ন বাস্তবতা — এক বিশাল ময়লার ভাগাড়। দুর্গন্ধে ভরা সেই জায়গাটি যেন রাঙামাটিকে জানিয়ে দিচ্ছে — পর্যটন শহরের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের কতটা উদাসীনতা !
রাঙামাটির পৌরসভার ঢোকার মুখেই রাঙামা টি বেতার স্টেশন সংলগ্ন এলাকার একটি বিস্তীর্ণ খোলা জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে ফেলা হচ্ছে শহরের বর্জ্য। পৌরসভার প্রতিদিনের ময়লা , আবর্জনা তো আছেই , এর সঙ্গে নিয়মিত ফেলা হচ্ছে হাসপাতালগুলোর মেডিকেল বর্জ্য , মৃত পশু - পাখি , এমনকি কসাইখানার উচ্ছিষ্টও। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা এসব বর্জ্য থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ , জমে থাকা ময়লায় জন্ম নিচ্ছে বিভিন্ন রোগবাহী মাছি , পোকামাকড়।
টানা বৃ ষ্টি হ লেই এই বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে কাপ্তাই লেকের পানিতে। ফলে কেবল মানুষ নয় , হুমকির মুখে পড়েছে রাঙামাটির জীববৈচিত্র্য ও পানিসংস্থান। দু র্বিষহ হ য়ে উঠ ছে স্থানীয়দের জীবন।
ভুক্তভোগী বাসিন্দা খালেদা আক্তার বলেন , বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারি না। বমি করতে করতে চলে যায়। দরজা - জানালা সব বন্ধ রাখলেও দুর্গন্ধ ঢুকে পড়ে ঘরে। ”
অপর বাসিন্দা জীবন চাকমা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন , এই জায়গাটা শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ। অথচ এখানেই বানানো হয়েছে ভাগাড়। এত গন্ধ , এত রোগ — ছোট ছোট বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ”
“ রাঙামা টি তে ঢোকার প থে দুর্গ ন্ধে গা গু লি য়ে উঠে। এত বা জে দুর্গন্ধ ! মাথা বের ক রে দে খি , রাস্তার পা শেই ময়লার ভাগার। ” — এমনই প্রতিক্রিয়া পর্যটক মাহমুদ খানের। মাহমুদের মতে , “ এক টি পর্যটন শহ রে প্রবেশ করার মু খে এত ময়লা - আবর্জনা মানায় না। এর থে কে যে কেউ শহ রের পর্যটন প রি বেশ ধারনা নি তে পার বে। ”
এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র দুর্গন্ধের কারণই নয় , বরং বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। হাসপাতালের সংক্রামক বর্জ্য , ইনজেকশন , অপারেশন সামগ্রী — সব মিশে যাচ্ছে খোলা মাটি ও কাপ্ত্ইা হ্রদের পা নি তে। সেখান থেকে পানি ও বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জীবাণু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন , এইভাবে চলতে থাকলে শহরের পানি , মাটি এবং বাতাস চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
কাপ্তাই হ্রদে ফেলা হচ্ছে নানা ধরনের বর্জ্য — প্লাস্টিক , গৃহস্থালি আবর্জনা , হোটেল - রেস্তোরাঁর ময়লা , এমনকি হাসপাতা লের বিষাক্ত বর্জ্যও। এতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে হ্রদের পানি। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে হ্রদের জৈববৈচিত্র্য। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাঙামাটির মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞা নিক কর্মকর্তা মো . খা লেদ।
তিনি বলেন , “ নানা ধরনের বর্জ্যে কাপ্তাই হ্রদ ক্রমাগতভাবে দূষিত হচ্ছে। এতে শুধু মাছ নয় , হ্রদকেন্দ্রিক সামগ্রিক পরিবেশ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে। কয়েকটি দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই , ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ”
রাঙামাটি একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন শহর হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু প্রবেশপথেই এমন একটি ভাগাড় এ শহরের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেও বাস্তবায়নে গতি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগ রিক প রিষ দের সভাপ তি মোহাম্মদ সোলায়মান ব লেন , ভাগাড়টি অবিলম্বে শহরের বাইরে নির্ধারিত স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।হাসপাতালের জন্য পৃথক বর্জ্য নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করে একে সম্পদে পরিণত করতে হব্।ে
রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন বলেন , এটি স রি য়ে শুধু ময়লা ফেলে রাখলেই হবে না। এই বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে আমরা সার তৈরি করতে পারি। এতে কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। ” তার মতে , আধুনিক বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করলে একদিকে পরিবেশ সুরক্ষিত হবে , অন্যদিকে তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান ও রাজস্ব।
পৌরসভা সূত্র জানায় , বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য শুকুরছড়ির ত্রিদিব নগরে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল পৌরসভার। প্রকল্পের সম্ভাব্য স্থান নির্বাচনের আগেই এই খবর পেয়ে যায় পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা - কর্মচারী জড়িত একটি চক্র।
এরপরই তারা স্থানীয় এক বাসিন্দা অনির্বাণ চাকমার কাছ থেকে ৩য় শ্রেণির পাহাড়ি চার একর জমি মাত্র ১০ লাখ টাকায় কিনে নেয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় , জমিটি শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে , যেখানে পরিবহনেরও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নেই।
পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের জন্য জমি ক্রয়ের অনুমতিপত্র আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই জমিই চার কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকায় পৌরসভাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এর ফলে জমি কেনাবেচার দামের ফাঁকে চার কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি রাষ্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয় বলেই অভিযোগ র য়ে ছে। প রি বেশ বিপর্য য়ের হুম কি তে স্থানীয় দের আন্দোল নের মু খে ওই প্রকল্প মুখ থুব ড়ে প ড়ে।
রাঙামাটি পৌরসভা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন জানান , ডাম্পিং স্টেশনের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে মাসিক সভায় আলোচনা হয়েছে। উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেলে দ্রুত এই ভাগাড় সরিয়ে ফেলা হবে। ” তিনি আরও বলেন , আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে , যেখানে ময়লা থেকে সার ও জ্বালানি উৎপাদনের চিন্তাও রয়েছে।
পর্যটন রাঙামাটি শুধুই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শহর নয় , এটি এখানকার মানুষের জীবনযাপন , সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক। প্রবেশমুখেই যখন একটি নগরীর পরিচয় হয় , তখন সেটি পরিচ্ছন্ন ও মনোরম হওয়া উচিত। আর সেই দায়িত্ব পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনের। সময় এসেছে দ্রুত এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়ার — অন্যথায় রাঙামাটি শুধু দুর্গন্ধ নয় , হারাবে তার স্বপ্নের বৈভবও।