কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রেঞ্জ কর্মকর্তা তৌহিদুরের বিরুদ্ধে

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ইছামতি রেঞ্জে গাছ পাচার, বনভূমি বেচাকেনা এবং সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎকে কেন্দ্র করে এক গভীর দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। এসব অনিয়মের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুর রহমান। তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, অবৈধ কাঠ পাচারে সংশ্লিষ্টতা এবং প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের অভিযোগ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে পুরো রেঞ্জজুড়ে যেন দুর্নীতির মহোৎসব শুরু হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুফল প্রকল্প, বাগান রক্ষণাবেক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থের একটি বড় অংশ সরাসরি আত্মসাৎ করা হয়েছে। রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুর রহমান নাকি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ৩১ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার নাম করে বরাদ্দের বড় অংশ নিজের পকেটে পুরে ফেলেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে মাঠপর্যায়ে কোনও দৃশ্যমান কাজ না করেই বিল উত্তোলন করা হয়েছে। এমনকি কর্মরত মাঠকর্মীদের ন্যায্য পাওনাও বঞ্চিত করা হয়েছে, অভিযোগ উঠেছে যে তাদের স্বাক্ষর জাল করে অর্থ উত্তোলন দেখানো হয়েছে।
সুফল প্রকল্পের অধীনে পূর্বে সৃজিত এক হাজার হেক্টর বাগান রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন ১০০ হেক্টর বাগান সৃজনের কথা থাকলেও বাস্তবে এই কাজগুলো কোথাও দৃশ্যমান নয়। বিভিন্ন এলাকায় পুরনো বাগানগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ হিসাবপত্রে দেখানো হয়েছে কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং খরচ হয়েছে পুরো বরাদ্দ। স্থানীয়রা বলছেন, এসব প্রকল্প শুধু কাগজে আছে, বাস্তবে নয়। বিষয়টি তদন্ত করলে একের পর এক জালিয়াতির প্রমাণ মিলবে।
রেঞ্জ কর্মকর্তা এই দুর্নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভেতরের কোনো স্টাফ প্রতিবাদ করলে তাদের নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। বদলি, বেতন কর্তন কিংবা শাস্তিমূলক নোটিশের ভয় দেখিয়ে কর্মীদের মুখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। একাধিক ফরেস্ট গার্ড অভিযোগ করেছেন, তারা প্রতিবাদ করায় হুমকি ও মানসিক চাপের শিকার হয়েছেন। এতে রেঞ্জে এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। কেউ কিছু বললেও গোপনে, প্রকাশ্যে নয়।
এই পরিস্থিতিতে বন বিভাগের ভেতরের কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহি কার্যত নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক প্রভাব ও ভেতরের শক্তিশালী চক্র এই দুর্নীতির সংস্কৃতি চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসী এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, শুধু রেঞ্জ কর্মকর্তা নয়, পুরো কাঠামোর মধ্যে যে ধ্বংসাত্মক দুর্নীতির চর্চা গড়ে উঠেছে তা দেশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি। তারা বলছে, সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ মানে শুধুই অর্থ লোপাট নয়, এটি জনগণের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখনই স্বচ্ছ, স্বাধীন এবং উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসা দরকার। জনগণের অর্থ এবং সম্পদের এই লুটপাট বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন কঠোর ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা। অন্যথায় এই রেঞ্জের মতো আরও অনেক জায়গায় দুর্নীতির বিষবৃক্ষ আরও গভীরে শিকড় গেড়ে বসবে, যার প্রভাব পড়বে আমাদের জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের ওপর।
এ বিষয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুর রহমান অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দৈনিক সাঙ্গুকে বলেন, বন রক্ষণাবেক্ষণ ও সৃজনে তার নামে যা বরাদ্দ ছিল, তা সম্পূর্ণ নিয়ম মেনেই খরচ করা হয়েছে। কাঠ পাচারে তার সহযোগিতার অভিযোগ ‘অসম্ভব’ বলে দাবি করে তিনি বলেন, বরং তিনিই কাঠ পাচার পুরোপুরি বন্ধ করেছেন।
তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। মাঠ পর্যায়ের লোকজন ও স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রকল্পের অর্থ নয়ছয়ের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের হাতে মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। যা শুধু একটি রেঞ্জ নয়, গোটা বন বিভাগের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।